তৃতীয় নয়ন ও রেইকি বা স্পর্শ চিকিৎসা
হাজার বছর পূর্বে যাকে বলা হত
প্রাণশক্তি, আমেরিকা আজ তাকেই বলছে
ইউনিভার্সাল লাইফ ফোর্স এনার্জি,
রাশিয়া বলছে বায়ো প্লাসমিক
এনার্জি; চীন বলছে চি; মাত্র দেড়শো
বছর আগে জাপানে তার নাম হয় রেইকি।
রেই-কি (Rei-ki) জাপানী শব্দ; ‘রেই’ অর্থ
বিশ্বব্রহ্মান্ড; ‘কি’ অর্থ জীবনীশক্তি।
অর্থাৎ রেইকি হচ্ছে বিশ্বব্রহ্মান্ডের
জীবনীশক্তি তথা মহাজাগতিক শক্তি।
এই পৃথিবীতে সবল ও সুস্থ দেহ নিয়ে বাঁচার
জন্য যে জীবনীশক্তি আমরা প্রতিনিয়ত
বিনামূল্যে পাচ্ছি, তা আসছে প্রাকৃতিক
৩টি উৎস থেকে সূর্যরশ্মি, মুক্ত বায়ু ও
মাটি। এ তিন শক্তির মধ্যে প্রধান হলো
সূর্যরশ্মি তথা সোলার এনার্জি। পৃথিবীর
বুকে ছড়িয়ে পড়া সূর্যের প্রাণশক্তিকে
মানবদেহের অসুস্থ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে প্রবেশ
করিয়ে তাকে সুস্থ করে তোলার প্রক্রিয়া
ও পদ্ধতি পুনরুদ্ধার করেছেন আধুনিক
রেইকির প্রবর্তক জাপানের ড. মিকাও
উসুই। মানবদেহে রয়েছে সাতটি চক্র
ক্রাউন চক্র, থার্ড আই চক্র, থ্রোট চক্র,
হার্ট চক্র, সোলার প্লেক্সাস চক্র,
স্যাক্রাল চক্র, রুট চক্র। এই প্রত্যেকটি
চক্র শরীরের একেকটি এন্ডোক্রিন
গ্ল্যান্ডের সঙ্গে সংযুক্ত। রেইকির কাজ
হলো বিশ্বব্রহ্মান্ডের বিশাল শক্তিকে
শরীরের চ্যানেলের মধ্য দিয়ে আবাহন
করিয়ে চক্রের মধ্যে প্রবাহিত করা। চক্র
থেকে শক্তি সঞ্চালিত হয় এন্ডোক্রিন
গ্ল্যান্ডে। প্রথম তিনটি চক্র হলো
আধ্যাত্মিক চক্র, শেষ তিনটি চক্রের
যোগাযোগ পৃথিবীর সঙ্গে। সোলার
প্লেক্সাস চক্রটি যুক্ত আমাদের হার্ট বা
হৃদয়ের সঙ্গে। পৃথিবী থেকে শক্তি আহরণ
করে আধ্যাত্মিক চক্র থেকে তা প্রবাহিত
হয় হার্টে। রেইকি মতে, হার্টের
এক্সটেনশন হচ্ছে হাত। কাজেই ব্রহ্মান্ড
থেকে আহরিত শক্তি গিয়ে জমা হয়
হাতের দশটি আঙুলের প্রান্তে। বেড়ে
যায় আঙুলের শক্তি, যে শক্তি দিয়ে
আরোগ্য হয় রোগের।
সূর্যরশ্মি বা মহাজাগতিক শক্তিকে
আহরণ করে দু’হাতের মাধ্যমে তা
ব্যাধিগ্রস্ত মানুষের শরীরে পৌঁছে
দেয়ার মানেই হলো প্রাণশক্তি প্রদান
অথবা ট্রান্সফার অব লাইফ ফোর্স
এনার্জি তথা রেইকি। যুগ যুগ ধরে
মহামানবগণ শুধুমাত্র হাতের স্পর্শেই
জরাগ্রস্ত ও ব্যাধিগ্রস্ত মানুষকে নিরাময়
করে এসেছেন। এতে কোনো যাদুমন্ত্রের
ব্যাপার বা বিষয় নেই; বরং রয়েছে
বিশেষ মানুষের বিশেষ জ্ঞান তথা
বিজ্ঞান। রেইকি বা স্পর্শ চিকিৎসার
মাধ্যমে নিজেই নিজের চিকিৎসক হওয়া
যায়। সামান্য কাশি থেকে ক্যান্সার
পর্যন্ত বিনা ঔষধে, বিনা অস্ত্রোপচারে
কেবলমাত্র হাতের স্পর্শ দিয়ে নিরাময়
করা যায়।
যেকোনো পরিস্থিতিতে, যেকোনো
স্থানে, যেকোনো সময়ে রেইকি শক্তি
প্রয়োগ করা সম্ভব। তবে ভোর চারটা
থেকে ছ’টার মধ্যে করলে বেশি কার্যকর
হয়। এ সময় ইউনিভার্স থেকে একটি বিশেষ
রশ্মি পৃথিবীতে আসে, যা শরীরের জন্য
অত্যন্ত উপকারী। এ রশ্মির হিলিং
পাওয়ার অনেক বেশি। কোনো আকস্মিক
দুর্ঘটনায় রেইকি হতে পারে ফার্স্ট এইড।
সাধারণ অসুখের ক্ষেত্রে ৩ দিনের রেইকি
চিকিৎসা যথেষ্ট। কঠিন রোগে চিকিৎসা
করতে হয় ২১ দিন।
একজন রেইকি মাস্টার নিজের শরীরে
কসমিক এনার্জি এবজর্ব করেন তার
শরীরের বিভিন্ন এন্ডোক্রিন গ্রন্থির
মাধ্যমে। এই এনার্জি হাতের মাধ্যমে
বাহিত হয় অন্যের শরীরে বা বস্তুতে।
রেইকি এনার্জি আপন গতিতে চলে। হয়ত
শরীরের যে সমস্যার জন্য রেইকি করা
হচ্ছে, তারচে’ বড় সমস্যা ঐ শরীরে আছে।
তখন কসমিক এনার্জি বড় সমস্যার স্থানেই
চলে যায়। বড় সমস্যার সমাধান শেষে
অন্যান্য ছোট সমস্যার সমাধান করে। এ
কারণে রেইকিকে বলা হয় স্বয়ংসম্পূর্ণ
চিকিৎসা পদ্ধতি।
রেইকি হলো স্লো বাট স্টেডি চিকিৎসা
পদ্ধতি; এটি কোনো ম্যাজিক নয়, বরং
সম্পূর্ণরূপে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান। অন্যান্য
চিকিৎসার পাশাপাশি রেইকি করলে
রোগীর মানসিক ও শারীরিক কষ্ট দূর হয়।
তাছাড়া এতে শরীর রেসপন্সও করে
বেশি। অর্থাৎ রেইকি পরোক্ষভাবে
চিকিৎসা পন্থার ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়।
এজন্যই বর্তমানে রেইকি মাস্টাররা
হাসপাতালের আইসিইউতেও প্রবেশের
অনুমতি পেয়ে থাকে। মানবদেহের
এনার্জি চক্র থেকে এন্ডোক্রিন গ্ল্যান্ড
পর্যন্ত যোগাযোগে যখন বিঘœ ঘটে, তখনই
শরীরে সমস্যা দেখা দেয়। আর এই
বিঘœতার কারণ আমাদের নেগেটিভ
এটিচিউড, নেগেটিভ ফিলিংস এবং
কনফিউশন এগুলোই বাধা তৈরি করে।
এগুলো থেকেই খাওয়া-দাওয়া ও
জীবনযাপনে নেগেটিভ এনার্জি চলে
আসে, দেখা দেয় রোগ-শোক। সাধারণত
রোগের লক্ষণ শরীরে থাকলেও এর মূল উৎস
মনে। যেমন আর্থ্রাইটিসের কারণ মনের
মধ্যে ভালোবাসা না পাওয়ার যন্ত্রণা,
এজমার কারণ মনের মধ্যে বদ্ধতা ইত্যাদি।
রেইকি মনের এই নেগেটিভ কারণগুলো দূর
করে, ফলে রোগ সেরে যায়।
রেইকির প্রধান সূত্র হল কুচিন্তা ত্যাগ
করে নিরন্তর শুভচিন্তা নিয়ে জীবন যাপন।
দীর্ঘদিনের নেগেটিভ চিন্তা আমাদের
শরীরে এনার্জি গ্রহণের প্রবেশপথ বন্ধ
করে দেয়। নেগেটিভ চিন্তার বদলে
পজিটিভ এনার্জির প্রতিনিয়ত ব্যবহারই
খুলে দিতে পারে শরীরে কসমিক এনার্জি
গ্রহণের সবক’টি দ্বার। রেইকি পজিটিভ
এনার্জি হওয়ায় মনের ওপর এর প্রভাব
অপরিসীম। এতে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি
পাল্টে যায়। সে সবকিছু পজিটিভ দৃষ্টিতে
দেখতে থাকে। রেইকি চিকিৎসায়
শেখানো হয়
১। আজকের জন্য আমি এই বিশ্বের কাছ
থেকে যা পেয়েছি, তার প্রতি কৃতজ্ঞ
থাকব;
২। আজকের জন্য আমি কোনো দুঃশ্চিন্তা
করব না;
৩। আজকের জন্য আমি মোটেই রাগ করব
না;
৪। আজকের জন্য আমি প্রতিটি কাজ
সৎভাবে করব;
৫। আজকের জন্য আমি প্রতিটি প্রাণির
প্রতি ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা প্রদর্শন
করব।
রেইকির মাধ্যমে এজমা, আর্থ্রাইটিস,
এলার্জি, আলসার, ডায়াবেটিস থেকে শুরু
করে যেকোনো ক্রনিক রোগ সারানো
যায়। রেইকি চিকিৎসা নিতে শারীরিক
কোনো প্রস্তুতির প্রয়োজন নেই। তবে
মানসিক প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে, কারণ
এতে মাইন্ড কনসেনট্রেশন করতে হয়।
রেইকি মাস্টারের মাধ্যমে সোলার
এনার্জি গ্রহণের আস্থা বা বিশ্বাস
এখানে জরুরি বিষয়।
যেকোনো এডিকশন বা আসক্তি ছাড়াতে,
বাচ্চাদের পড়াশোনায় মনোযোগী করতে,
সম্পর্ক উন্নয়নে, ওজন কমাতে রেইকি
চমৎকার ফল দেয়। রেইকি মন ও শরীরের
মধ্যে সমন্বয় সাধন তথা ভারসাম্য রক্ষা
করে। শরীর ও মনের ভারসাম্য থাকলে
শরীরে অসুখ বাসা বাঁধতে পারে না।
খাবারের ওপরও রেইকি করা যায়। এতে
খাবারের পুষ্টিগুণ বাড়ে। রেইকির শক্তি
খাবারের ক্ষতিকর উপাদান মুছে ফেলে।
তাই রেইকি করলে খাবার হজম হয় ভালো।
রেইকি চিকিৎসা গ্রহণের সময় এমন খাবার
খাওয়া উচিত নয়, যা খেলে শরীরে টক্সিন
জমে। যেমন চা, কফি, সিগারেট,
এলকোহল প্রভৃতি। বরং কাঁচা বা সেদ্ধ
সব্জি ও ফল খাওয়া উচিত। কারণ এগুলোর
‘র’ এনজাইম শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা
বাড়িয়ে তোলে। তাছাড়া এ সময় প্রচুর
পানি পান করা উচিত।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন