লাভার জ্বীন বিষয়ক

লাভার জ্বিন বিষয়ক

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম,

লাভার জ্বিন বিষয়ক



জিন আল্লাহর এক সৃষ্টি। কোরআনে তাদের সৃষ্টি সম্পর্কে অনেকগুলো আয়াত রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,

– “তিনি জিনকে সৃষ্টি করেছেন ধোঁয়াবিহীন অগ্নিশিখা থেকে।” (সুরা আর-রাহমান ১৫)
– “এর পূর্বে উত্তপ্ত আগুন থেকে জিনকে সৃষ্টি করেছি।” (সুরা হিজর ২৭)
.
আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয় হলো, আশিক জিন বা প্রেমিক জিন। এই জিন আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে প্রবেশ করে কুৎসিত এবং আপত্তিকর উপায়ে তাকে ব্যবহার করে থাকে। এটা এক প্রকার জুলুম এবং এ থেকে নিস্তার পেতে শরীয়তসম্মত পদ্ধতিতে রুকইয়াহ করা উচিত। জিনের সমস্যাগুলোর মাঝে এই ধরনের সমস্যাগুলো সাধারণত তুলনামূলক জটিল এবং ঝামেলাপূর্ণ হয়। যদিও এটা নতুন কোন বিষয় না, তবুও অধিকাংশ মানুষে এব্যাপারে ভুল ধারণা রাখে।

শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, “জিন যৌন ইচ্ছা পূরণ করার জন্য, খারাপ ইচ্ছা অথবা ভালোবাসা থেকে মানুষকে দখল করার চেষ্টা করে। এটা ফাহেশা (অশ্লীল) এবং নিষিদ্ধ আচরণ, এমনকি যদি সেটা দুইজনের সম্মতিতে হয় তবুও। আর যদি জিন সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছায় এই কাজ করে তাহলে এটা জুলুম।”
যারা এরকম করে তাদেরকে জানানো উচিত, মানুষ এবং জ্বিনদের জন্য আল্লাহ এবং রাসুল সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আইন অনুযায়ী তাদের বিচার হবে। ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, “আনন্দ হাসিলের অর্থ হচ্ছে, নিজের ইচ্ছামত কারো কাছ থেকে কোনকিছু নিয়ে নেয়া বা যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে তাকে ব্যবহার করা। কিন্তু কোন জুলুমই শেষ অবধি শাস্তিবিহীন থাকবে না, তা ইহকালে হোক কিংবা পরকাল। যেমনটা আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,

“সেদিন তিনি তাদের সবাইকে একত্রিত করবেন, বলবেন, হে জিন সম্প্রদায়, তোমরা তো অনেক মানুষকেই গোমরাহ করেছো, মানুষের মধ্যে থেকে তাদের বন্ধুরা বলবে, হে আমাদের মালিক, আমরা একে অপরের দ্বারা দুনিয়ার জীবনে লাভ করেছিলাম, আর এভাবেই আমরা চুড়ান্ত সময়ে এসে হাজির হয়েছি, যা তুমি আমাদের জন্য নির্দিষ্ট করে রেখেছিলে; তিনি (আল্লাহ তায়ালা) বলবেন, তোমাদের ঠিকানা হচ্ছে জাহান্নাম, সেখানে তোমরা চিরকাল থাকবে। অবশ্য আল্লাহ তায়ালা যা কিছু চাইবেন (তা আলাদা); তোমার মালিক অবশ্যই প্রজ্ঞাময়, সম্যক অবহিত।”
(সুরা আনআম, ১২৮)”

চরিত্র, শক্তি, চেহারাভেদে এ ধরনের জ্বিনরা অনেক রকমের হয়। মানুষ যেরকম একজন আরেকজনের প্রতি ভালোবাসা, কেয়ার করা ইত্যাদি নানাভাবে আবেগপ্রবণ হয়ে যায় সেরকমই কোন কোন জিন আক্রান্ত ব্যক্তির প্রতি বেশ কেয়ারিং হয়ে যায়। আবার কোন জিন বিভিন্ন শারীরিক এবং মানসিক সমস্যা সৃষ্টি করে ব্যক্তির দেহ ‘উপভোগ’ করা শুরু করে। এরকম জিন আক্রান্ত ব্যক্তির জীবনে অনেক জটিলতা তৈরি হয়। চারপাশের সবার সাথে তাদের সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। বিভিন্ন কারণে মানুষ এরকম জিন দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে, রুকইয়া ইনডেক্সের জিন সিরিজে জিন অধ্যায়ে আক্রান্ত হওয়ার কারণ নিয়ে আলোচনা আছে।

[খ]

লাভার জীনের প্রকারভেদ
১। এক প্রকার আশিক জ্বিন হলো- যারা ব্যক্তির দেহকে ভালোবাসে এবং দেহের প্রতি মোহাবিষ্ট হয়ে পড়ে এবং এই দেহে তাদের সবরকম অধিকার আছে বলে মনে করে। আক্রান্ত ব্যক্তির দেহকে শুধুই একটা ভোগের বস্তু মনে করে। কেউ কেউ মনে করে আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। আক্রান্ত ব্যক্তি বিবাহিত হলে জিন তাদের বিবাহিত জীবনে অনেক জটিলতা তৈরি করে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মাঝে নানান জটিলতা সৃষ্টি করে শেষ অবধি তালাক পর্যন্ত নিয়ে যায়। আক্রান্ত ব্যক্তি অবিবাহিত হলে তার বিবাহ নিয়ে নানান জটিলতা তৈরি করে বিয়েকে প্রায় অসম্ভব করে তোলে।

২। আরেক প্রকার জিন ব্যক্তির দেহের কোন একটা নির্দিষ্ট অঙ্গের প্রতি মুগ্ধ হয়ে পড়ে। যেমন- চোখ, হাত, মুখ, চুল ইত্যাদি। এই ‘ভালোবাসার’ কারণেই সে আক্রান্ত ব্যক্তিকে নানান সমস্যা ফেলে দেয়। যেমন- নানান শারীরিক অসুস্থতা, বৈবাহিক জীবনে অশান্তি, অবিবাহিতদের বিয়েতে ঝামেলা। এই ক্ষেত্রে দেখা যায় তুচ্ছ কারণে অথবা কোন কারণ ছাড়াই বিয়ে হচ্ছেনা বা প্রস্তাব আসলেও পরে আর কোন যোগাযোগ নাই।

৩। এই প্রকারের আশিক জিন অনেক বেশি ক্ষতিকর এবং এরা ফাহশা বা অশ্লীল কাজে আক্রান্ত ব্যক্তিকে ব্যবহার করে। পার্ভার্ট / বিকৃত রুচির জিন বলতে পারেন। মানসিক এবং শারীরিকভাবে অনেক টর্চার করে, কখনো তাদের পরিচিত অথবা অপরিচিত মানুষের রূপে এসে ধর্ষণ করে। এটা স্বপ্নের মত অথবা জাগ্রত অবস্থায়ও হতে পারে। কখনো আক্রান্ত ব্যক্তির বন্ধু বা তার সাথে যে থাকে তাকেও পজেস করে আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে অনৈতিক সম্পর্কে জড়ানোতে উদ্বুদ্ধ করে। আক্রান্ত ব্যক্তিকে সমকামীতায় অথবা কোন প্রানীর সাথে শারীরিক সম্পর্কেও জড়াতে চায় অনেকসময়।

৪। আমাদের মধ্যে যেমন গরু ছাগলের মত জন্তু জানোয়ার আছে, জিনদের মধ্যেও তাদের নিজস্ব জন্তু জানোয়ার আছে। জিনদের মধ্যে কিছু জন্তু জানোয়ার অন্য প্রানীদের সাথে শারীরিক সম্পর্কে জড়াতে চায়। এই উদ্দেশ্যে তারা আক্রান্ত ব্যক্তিকে ব্যবহার করে বিভিন্ন জন্তু জানোয়ারের সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে। এরকম সম্পর্ক আজকাল বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় দেখা যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তি বুঝতে পারেনা কেন তাদের মাথায় এরকম চিন্তা আসছে আর কেনইবা তারা এরকম জঘন্য কাজ করছে। এতে তাদের মধ্যে একধরনের হতাশা, উদ্বেগ, ঈমানের ঘাটতি তৈরি হয়। সবচেয়ে ভয়াবহ হল, এতে আক্রান্ত ব্যক্তি অনেক ক্ষেত্রে আত্মহত্যা করে বসে।

৫। এই প্রকারের জিন প্রতিরাতে আসে আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য। সে ব্যক্তির শরীরে বসবাস করেনা। আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে তার ‘অধিকার’ আছে এরকম ধারণা থেকে নিজের ইচ্ছামত আসে এবং চলে যায়। এরকম রোগীর সংখ্যা বেশি, এর প্রতিকার নিয়ে “রাত্রিতে জিনের সমস্যা” প্রবন্ধে আলোচনা করা হয়েছে।

৬। কিছু জিন অনেক দিন পরপর আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে আসে এবং শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে। মাঝখানের এই সময়ে সে নিজেদের পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ায় অথবা অন্য কোন মানুষের সাথে কুকর্মে লিপ্ত থাকে।

৭। অন্য কিছু আশিক জিন আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেনা কিন্তু ব্যক্তির প্রতি একধরনের আকর্ষণ অনুভব করে। মানুষের মধ্যে যেমন উত্ত্যক্তকারী থাকে তেমনি এই জিনও আক্রান্ত ব্যক্তিকে দূর থেকে দেখে দেখে উপভোগ করার চেষ্টা করে। এভাবে থাকতে থাকতে একসময় কখনো সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্যক্তিকে পজেস করারও চেষ্টা করতে পারে।

৮। পেডোফাইল বা বাচ্চাদের প্রতি আকৃষ্ট জিন। এই জিন বাচ্চাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাদেরকে সঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করে তার দেহে বসবাস শুরু করে।
——————————

উপরের যেকোন ক্ষেত্রে দেখা যেতে পারে জিন আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে অনেকদিন ধরে বসবাস করে তাকে প্রভাবিত করে এমন অবস্থা তৈরি করেছে যে, জিন এবং মানুষের আচরণ আলাদা করা অনেকসময় কঠিন হয়ে যায়। মানুষের শরীরে থাকতে থাকতে এদের এমন একগুয়ে অবস্থা হয় অন্য কোথাও যেতে চায়না। নিজের জীবন দিয়ে হলেও আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে থাকতে চায়। কখনো আক্রান্ত ব্যক্তি মারা গেলে সে অন্য কোন ব্যক্তির উপর আসর করে। ভয়ানক বিষয় হল, অনেক মানুষকে এরা এমনভাবে প্রভাবিত করে যে, সে এই শয়তান জিনকে একপ্রকার ভালোবেসে ফেলে এবং তার থেকে পরিত্রাণও চায় না। মনে করে যে, থাকলেই ভাল আছি! কেউ একজন সাথে আছে! নাউযুবিল্লাহ।



[গ]

লাভার জিন আক্রান্ত ব্যক্তিদের যেসব লক্ষণ দেখা যায় –
১। উপরে যেসব লক্ষণ বলা আছে এর পাশাপাশি নানারকম উন্মত্ত আচরণ দেখা যায়। দুঃখে নিজের প্রতি বিতশ্রদ্ধ হয়ে যাওয়া এবং নিজেকে সমাজ থেকে আলাদা মনে হওয়া। একা একা থাকতে ভালোলাগা। কোলাহল এবং সামাজিক মেলামেশা অপছন্দ হওয়া। আর জিন আক্রান্ত হওয়ার যে লক্ষণগুলো পূর্বে জিন সিরিজে বলা হয়েছে, সেগুলোও খেয়ালে রাখা উচিত।

২। প্রকৃতপক্ষে সুন্দর বা আকর্ষণীয় হওয়ার পরেও বিপরীত লিঙ্গের কারো প্রতি কোন আকর্ষণ বা কোন অনুভুতি না হওয়া। পুরুষ অথবা মহিলাদের বিয়ের প্রস্তাব আসার পর প্রস্তাবদাতাকে শারীরিক অথবা চারিত্রিক দিক দিয়ে অযোগ্য মনে করা এবং শেষে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া।

৩। চর্মরোগ এবং অন্যান্য শারীরিক সমস্যা দেখা দেওয়া যা আক্রান্ত ব্যক্তির কষ্ট আরো বাড়িয়ে দেয়। এসবের মাধ্যমে জিন মনে করে যে ব্যক্তিটি তার ‘নিয়ন্ত্রণে’ আছে।

৪। সবচেয়ে মারাত্মক বিষয়টা হল আক্রান্ত ব্যক্তি নিজে বুঝতে পারছেন যে তাকে শারীরিকভাবে আক্রমন করা হচ্ছে অথবা ধর্ষন করা হচ্ছে অথচ কিছুই করতে পারছেন না। এটা আক্রান্ত ব্যক্তির উপর খুবই বাজে একটা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।



[ঘ]

লাভার জিন চিহ্নিত করা
শুরুতে জিনের সমস্যা আছে কি না, এটা বুঝতে জিন আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণগুলো মিলিয়ে নিতে হবে। জিন সিরিজে এর অনেকগুলো লক্ষণ আলোচনা করা হয়েছে। সাধারণত সবধরনের জিনের ক্ষেত্রেই এই লক্ষণগুলো দেখা যায়।
তবে এই কেসে আরও যে বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে পারেন –
.
১। জিন এবং তার প্রকৃতি চিহ্নিত করা গেলে আল্লাহ চায়তো আক্রান্ত ব্যক্তি এবং রাকীর জন্য রুকইয়াহ করা সহজ হবে। প্রথম বিষয় যা জানার চেষ্টা করতে হবে তা হলো- জিন কেন এখানে এসেছে। সাধারণত রুকইয়াহ করার সময় জিনের কাছে থেকেই স্বীকারোক্তি আদায় করা যায়। কিছুক্ষণ রুকইয়াহ করার পর জিজ্ঞেস করতে হবে কেন এসেছে? তবে বলার সাথে সাথে জিনের কথা বিশ্বাস করা যাবে না, কারণ তারা খুব বেশি মিথ্যা বলে।

২। আল্লাহ চাইলে আক্রান্ত ব্যক্তির স্বপ্নের মাধ্যমেও জিনকে চিহ্নিত করা সম্ভব। এইক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তি নির্দিষ্ট সময় পরপর অথবা প্রায়ই একইরকম স্বপ্ন দেখে। তাই স্বপ্নের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করতে হবে। স্বপ্নে, ঘুমের মাঝে এবং ঘুম থেকে উঠে কেমন অনুভূতি হয় এটাও খোঁজ নিতে পারেন।

৩। হঠাৎ করে ব্যক্তির স্বভাব চরিত্রে পরিবর্তন আসে। হারাম কাজের দিকে বেশি ঝুঁকে যাওয়া তারমধ্যে অন্যতম। যেমন- জুয়া খেলা, মদপান, ধূমপান, যিনা বা অনৈতিক কাজের প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করা ইত্যাদি। কখনো জন্তু জানোয়ারের সাথে আবার কখনো পেডোফাইল বা বাচ্চাদের প্রতি শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করা অথবা স্থাপনের আকর্ষণ অনুভব করা। ছেলেরা মেয়েদের মত সাজগোজ করা, তাদের মত পোশাক পরা, লিঙ্গ পরিবর্তনে আগ্রহী হওয়া। হঠাৎ করে চরিত্রে এরকম পরিবর্তন আসা (বিশেষ করে যৌন চাহিদা বা আগ্রহের দিকগুলোতে) লাভার জিন আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম লক্ষণ।

৪। লাভার জিন সাধারনত বাচ্চাদের অপছন্দ করে। বিশেষ করে যেসব বাচ্চারা আক্রান্ত ব্যক্তির আত্মীয় অথবা পরিচিত। স্বামী স্ত্রীর স্বাভাবিক সম্পর্কে বাধা দেয়া, তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটানো উস্কে দেয়া লাভার জীনের সাধারন বৈশিষ্ট্য। স্বামী স্ত্রীর বিচ্ছেদের মাধ্যমে আক্রান্ত ব্যক্তিকে নিজের করে পেতে চাওয়ার মানসিকতা থেকে শয়তানরা এই কাজটা করে। যাদের বিয়ে হয়নি তাদের বিয়েতে নানান জটিলতা তৈরি করে বাধা দেয়। কখনো লাভার জিন বিয়ের জটিলতা তৈরি না করে বিয়েটা স্বাভাবিকভাবে হতে দেয়। এটা তখন হয়, যখন দেখা যায় স্বামী স্ত্রীর স্বাভাবিক শারীরিক সম্পর্ক হওয়ার সম্ভবনা অনেক কম থাকে। যেমন- যদি এমন সম্ভাবনা থাকে যে, স্বামী দূরে কোথাও থাকবে এবং স্ত্রী বেশিরভাগ সময়েই একা থাকবে।

৫। গোত্রপ্রধান বা সর্দার জিন থাকতে পারে কখনো। এরা এমন যে, জিনদের মধ্যে তার নিজের একটা দল আছে যারা তার কথামত বিভিন্ন কাজ করে। এই জিন তার বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে আক্রান্ত ব্যক্তি এবং চারপাশে একটা কঠিন পরিস্থিতি গড়ে তোলার চেষ্টা করে। এই নেতা জিন আক্রান্ত ব্যক্তিকে নিজেই বদনজর, হিংসা, যাদুর মাধ্যমে নানান প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে যাতে তার চিকিৎসা পদ্ধতিতে সার্বিকভাবে বাধা দেয়া যায়।

————————

জিন চিহ্নিত করার আগে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল আক্রান্ত ব্যক্তির স্বভাব চরিত্রের দিকে নজর দেয়া। সে বয়সন্ধিকালে আছে কিনা, পর্ন দেখে কিনা, শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের তীব্র ইচ্ছা আছে কিনা এই বিষয়গুলো দেখতে হবে। ছোটবেলায় যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিল কিনা সেটাও দেখা দরকার (অনেক জিন এই সময়টাতে ব্যক্তির শরীরে প্রবেশ করে)। খতিয়ে দেখতে হবে যে এসব ব্যক্তির চরিত্রগত সমস্যা নাকি জিন আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ। যেভাবেই হোক, এগুলো বন্ধ করতে হবে প্রথমে।
.
কিছু লাভার জিন অনেক প্রটেক্টিভ বা ঈর্ষাপরায়ণ হয় (আক্রান্ত ব্যক্তিকে সকল প্রকার ঝামেলা থেকে তাকে বাঁচিয়ে দেয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করে)। এরা অনেক ক্ষেত্রেই রোগীকে তেমন কোন ক্ষতির চেষ্টা না করে চুপচাপ বসে থাকে। আবার কিছু জিন আছে যারা ব্যক্তিকে সবদিক দিয়ে ক্ষতি করার চেষ্টা করে। নিচে এমন কিছু অবস্থা আলোচনা করা হল-

.
১. ব্যক্তিকে হতাশ এবং একাকী করে দেয়ার মাধ্যমে নানান হারাম কাজে লিপ্ত করা।

২. স্লো পয়জনিং এর মত ব্যক্তিকে ধীরে ধীরে ঈমানহারা করতে থাকা। যেমন- মহিলাদের ক্ষেত্রে হঠাৎ হিজাব ছেড়ে দেয়া, পুরুষের ক্ষেত্রে দাঁড়ি শেভ করা ইত্যাদি।

৩. গাইরে মাহরাম (যাদের সাথে বিয়ের সম্পর্ক জায়েজ) পুরুষ ও মহিলাদের সাথে কথা বলার অভ্যাস তৈরি করার মাধ্যমে ধীরে ধীরে লজ্জাকে উঠিয়ে দেয়া। এভাবে শেষে আরো হারাম কাজের দিকে নিয়ে যাওয়া।

৪. জিনদের মধ্যে যারা যাদুকর তাদের সাহায্য নিয়ে আক্রান্ত ব্যক্তিকে যাদু করা এবং অবস্থা আরো জটিল করে তোলার চেষ্টা করা।

৫. পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে ব্যক্তির অবস্থা খারাপ করে দিয়ে তাকে নোংরা এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকতে অভ্যস্ত করে তোলা।

৬. আক্রান্ত ব্যক্তির এমন সব জটিল অসুখ হওয়া যা মেডিকেল সাইন্স ব্যখ্যা করতে পারেনা বা মেডিকেল সাইন্সে এর কোন সমাধান নেই। অথবা এমন সব অসুখ হওয়া যা ব্যক্তিকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়। যেমন- ক্যান্সার।

৭. শারীরিকভাবে আক্রমণ করা। শরীরের বিভিন্ন জায়গাতে আঘাত করা যেমনঃ বিভিন্ন সময় হাতে-পায়ে আঘাতের চিহ্ন দেখতে পাওয়া, গোপনাঙ্গ ফুলে উঠা, লজ্জাস্থানের চারপাশে ব্যথা করা এবং অস্বস্তি হওয়া যা ওষুধে ভালো হয়না।

৮. নানান হারাম কাজে ব্যক্তিকে লিপ্ত করা এবং এগুলো ব্যক্তির স্বাভাবিক অভ্যাসে পরিণত করা।

৯. মহিলাদের ক্ষেত্রে, পুরুষের দিকে তাকাতে বাধা দেয়া। এটা সাধারণত উপরে বলা সর্দার জিন দ্বারা আক্রান্ত হলে হতে পারে। একইরকম সমস্যা পুরুষদের ক্ষেত্রেও হতে পারে।

১০. সারাদিন অথবা দিনের বেশিরভাগ সময়ে উত্তেজিত রাখা এবং লিঙ্গ থেকে যৌন উত্তেজক পদার্থ নির্গত হওয়া। এটা এত বেশি সমস্যা তৈরি করে যে শেষে মাস্টারবেশন বা হস্তমৈথুন অথবা যিনায় (অনৈতিক সম্পর্কে) গিয়ে শেষ হয়।

১১. নিজের কূরুচিপূর্ণ অথবা অশ্লীল ছবি অপরিচিত মানুষকে পাঠাতে উসকে দেয়া।

১২. বিবাহিত মহিলাদের স্বামীর সাথে শারীরিক সম্পর্কের সময় প্রশান্তি পেতে বাধা দেয়া বা এই সময়ে মহিলাদের একদম অনুভূতিহীন করে দেয়া। পুরুষের ক্ষেত্রে স্ত্রীকে প্রশান্তি দেয়া বা সন্তুষ্ট করা থেকে বিরত রাখা। কখনো শারীরিক সম্পর্কের সময় স্বামী বা স্ত্রীকে পুরোপুরি আসর করে নিজে কন্ট্রোল নিয়ে নেয়া।

১৩. এনাল সেক্স বা পায়ুকামে লিপ্ত করানো।

১৪. অপ্রয়োজনীয় শো অফ করে পুরুষ/মহিলাদের নিজের দিকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করা বা বদনজরে আক্রান্ত করা।

১৫. আক্রান্ত ব্যক্তিকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করা এবং মৃত্যুর পরে ব্যক্তিকে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে আক্রমণ করা। এই জিন আক্রান্ত ব্যক্তিকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত অথবা আল্লাহর ইচ্ছায় আরোগ্য হওয়া পর্যন্ত অশ্লীল কাজের দিকে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে।



[ঙ]
নোটঃ এই ধরনের জিন অত্যন্ত খারাপভাবে সমাজে অনৈতিক কাজ, পাপাচার বৃদ্ধির মাধ্যমে বিশৃংখলা তৈরির চেষ্টা করে। এরকম জিন দ্বারা আক্রান্ত ব্যক্তি চিহ্নিত করতে পারলে তার উচিত সমস্ত গুনাহের জন্য তাওবা করা, খালিস দিলে সবকিছুর জন্য মাফ চাওয়া এবং যাবতীয় খারাপ কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখার চেষ্টা করা এবং এজন্য আল্লাহর কাছে সবসময়ই সাহায্য চাওয়া। আক্রান্ত ব্যক্তি অবিবাহিত হলে তাদের উচিত বিয়ে করা অথবা রোজা রাখা। তাদের দৃষ্টি ও লজ্জাস্থানের হিফাজত করার সর্বাত্মক চেষ্টা করা। আক্রান্ত ব্যক্তি বিবাহিত হলে, স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক বৃদ্ধির চেষ্টা করা উচিত। নিজেদের মধ্যে পরষ্পর বোঝাপড়া, ভালোবাসা বৃদ্ধি করা এবং চিকিৎসার সকল বিষয়ে একে অন্যকে সাহায্য করা উচিত। স্ত্রী তার স্বামীর প্রতি আরো বেশি অনুগত হওয়া এবং আল্লাহর জন্য স্বামীকে সর্বাত্মক খুশি রাখার চেষ্টা করা উচিত। স্বামীর উচিত স্ত্রীর প্রতি আরো বেশি ভালোবাসা দেখানো, স্ত্রীকে বুঝার চেষ্টা করা, স্ত্রীর প্রতি আরো মনযোগী হওয়া এবং স্ত্রীকে খুশি রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করা।

আক্রান্ত ব্যক্তি উপরে বলা হারাম কোন কাজে জড়িত থাকলে সেটা অবশ্যই ত্যাগ করা উচিত। বেশি বেশি তাওবা ইস্তেগফার করা এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করা।

আরেকটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে, এসব সমস্যা নিয়ে খুব বেশি চিন্তা ভাবনা না করা। সমস্যাকে বড় করে দেখে সেটা নিয়ে হতাশাগ্রস্থ বা আতংকিত হওয়া থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। এটা মনে রাখতে হবে যে, সমস্যা যেহেতু হয়েছে তারমানে আল্লাহ চাইলে শিফাও হবে। আল্লাহর হাতেই রয়েছে যাবতীয় রোগের আরোগ্য। মনে প্রাণে এই বিশ্বাস রাখতে হবে যে, আল্লাহ চাইলেই সমস্যা ভালো হয়ে যাবে। মনে রাখতে হবে, কষ্টের পরেই আসে প্রশান্তি। আল্লাহ বলেন,

“নিশ্চয় কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে। আর নিশ্চয় কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে।” সূরা ইনশিরাহ, ৫-৬

ট্রিটমেন্ট-
১। প্রতিনিয়ত আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করা। প্রতিদিন কোরআন তিলাওয়াত করা, সাওয়াবের কাজ করা, রোজা রাখা, আল্লাহর জিকিরে নিজেকে ব্যস্ত রাখা এবং কথা বলার সময়ে জিহ্বাকে সংযত রাখা, প্রতিনিয়ত আল্লাহর সাহায্য চাওয়া এবং বেশি বেশি তাওবা ইস্তেগফার করা।

২। কদিন পরপরই সরাসরি রুকইয়াহ করানো। আর অভিজ্ঞ রাকীর নির্দেশনায় নিজে নিজে প্রতিদিন সেলফ রুকইয়াহ করা। নিয়মিত রুকইয়াতে দৃঢ় থাকা। রুকইয়ার আয়াত পড়া কালোজিরা তেল, অলিভ অয়েল, মধু, পানি ব্যবহার করা। ডিটক্স করা।

৩। রুকইয়াহ গোসল করা এবং রুকইয়াহ শোনা। এক্ষেত্রে সিহরের অডিও, আয়াতুল হারকের অডিও, রুকইয়া যিনার অডিও শোনা যেতে পারে। আর জিন সিরিজে আলোচিত রুকইয়াহ পরবর্তী নির্দেশনাগুলো খেয়াল রাখা।

৪। সুরা বাকারা, নূর, ইউসুফ তিলাওয়াত করা। তিলাওয়াত করতে না পারলে অডিও শোনা।

৫। সম্ভব হলে জীনের দূর্বলতা এবং তার অপছন্দের কাজগুলো খুঁজে বের করা এবং অপছন্দের কাজগুলো করা (শরিয়াহ বাধা না দিলে)।

৬। বাসা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা এবং রুকইয়াহর আয়াত পড়া পানি পুরো বাসায় ছিটিয়ে দেয়া বা স্প্রে করা। বাসায় নিয়মিত কোরআন তিলাওয়াত করা, কোরআন তিলাওয়াতের অডিও প্লে করা। হারাম কোনকিছু বাসায় যেন না থাকে সেদিকে খেয়াল করা। যেমন- যেকোন মূর্তি, ঝুলানো ছবি, বাসায় কুকুর রাখা, গান বাজনা হওয়া এবং টিভিতে অশ্লীল অনুষ্ঠান দেখা।

৭। কিছু নির্দিষ্ট সময় পরপর হিজামা করা। জমজমের পানি ও খেজুর খাওয়া।

৮। বিবাহিতদের জন্য ট্রিটমেন্টের মূল বিষয় হল স্বামী/স্ত্রীর ভূমিকা। একে অন্যের প্রতি রাগান্বিত না হওয়া, বেশি বেশি ভালোবাসা এবং একে অন্যকে কেয়ার করা, আনন্দে রাখার চেষ্টা করা। সর্বোপরি বাসায় ভালোবাসাময় একটা পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং পরষ্পরের দূরত্ব যথাসম্ভব কমিয়ে আনা।

৯। পরিবারের বাচ্চাদের জড়িয়ে ধরা, চুমু খাওয়া, স্বামীর সাথে শারীরিক সম্পর্কে সময় বৃদ্ধির চেষ্টা করা এবং সেসময় পুর্ণ মনযোগ দেয়া, ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছানো ইত্যাদি। এসব আচরণ শয়তান জিনরা অপছন্দ করে।

১০। শরীরের কোথায় জিন আছে সেটা খুঁজে বের করে রুকইয়ার আয়াত পড়ে সেখানে ফুঁ দেয়া যায়, পড়ার পরে সেখানে হালকাভাবে থুথু ছিটিয়ে দেয়া। রুকইয়ার তেল, পানি ইত্যাদিও আক্রান্ত স্থানে ব্যবহার করা যায়।

১১। যতই ভয় দেখাক, ঝামেলা করুক, বিভিন্ন কথাবার্তা বলে একজনের প্রতি আরেকজনকে বিষিয়ে তোলার চেষ্টা করুক, জিনকে কোন প্রকার পাত্তা না দেয়া। এসব জিনরা চায় আমরা তাদের গুরুত্ব দেই। তারা নিজেদেরকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে ভালোবাসে, এজন্য বিভিন্ন মিথ্যা কিচ্ছা কাহিনী বর্ণনা করে।

১২। হতাশ না হওয়া। একা একা না থেকে সবসময়ই কোন না কোন কাজে ব্যস্ত থাকা। পারতপক্ষে একা না ঘুমানো।

১৩। কারো দিকে বেশি প্রশংসার দৃষ্টিতে না তাকানো। আয়না দেখার সময়ে অবশ্যই দোয়া পড়া। কাপড় বদলানোর আগে বিসমিল্লাহ বলা।

১৪। বেশি বেশি আয়না দেখার অভ্যাস থাকলে রুকইয়ার পানি আয়নাতে ছিটিয়ে দেয়া উচিত এবং আয়না সবসময় ঢেকে রাখা উচিত।

১৫। সবচেয়ে জরুরী বিষয়! দোয়া করা। দোয়া মুমিনের সবচেয়ে বড় অস্ত্র। দিনের অধিকাংশ সময়ে দোয়া করা। দোয়ার জন্য আলাদা সময় বের করে নেয়া। দুই হাত তুলে রবের নিকট দোয়া করা, যেন আল্লাহ এই সমস্যা পুরোপুরি ভালো করে দেন এবং তাদেরকে যেন আল্লাহর উপর ভরসা করে ধৈর্য্য ধরার তৌফিক দেন।

পুরাতন পোষ্ট গুলি দেখুন