রত্ন ‌‌মন্তু ও ‌কবযে ‌ভাগ্য ‌ফেরানো:


রত্ন মন্ত্র ও কবচে ভাগ্য ফেরানোঃ

রত্ন-মন্ত্র বর্ণনাঃ

রত্ন ব্যবহার হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসছে। সভ্যতার আলোকে উদ্ভাসিত হয়েছে যখন যে সব দেশ, নিজেদের নব নব রুপে সাজানোর জন্য নরনারী তখন থেকে সোনা রুপার গহনার সঙ্গে রত্ন ধারণ করা শুরু করে। ইতিহাস পূর্বকালে আদিম নরনারী বিবস্ত্রাবস্থায় বসবাস করলেও, তারা তাদের নগ্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে নানা প্রকার উল্কি আঁকতো, আর কণ্ঠে, বাহুতে এবং কোমরে পরতো নান প্রকার জীবজস্তর হাড়, দাঁত প্রভৃতি। সঙ্গে ফলের বীজও ধারণ করতো। এবং দেহের উল্কি থেকে শুরু করে কণ্ঠাদির হাড় তারা দলের পুরোহিতদের দ্বারা মন্ত্রপূত করে নিতে ভুলতো না। কারণ সেই সভ্যতাবিহীন মানুষের দল তখন থেকেই মনে মনে দৃঢ় বিশ্বাস করতো- এইগুলি মন্ত্রের দ্বারা শুদ্ধ করে নিলে কোনো অপদেবতা, কোনো দুর্যোগ এবং কোনো বাধা বিপত্তি তাদের ক্ষতি সাধন করতে পারবে না। এমন কি তারা নিবিড় অরণ্যের মধ্যে নানা প্রকার সরু- মোটা লতা দেহে ব্যবহার করতো মন্ত্রশুদ্ধি করে। সে যুগের মানুষ তাদের ক্ষীণ বুদ্ধি দৃষ্টিতে জেনেছিলো, জন্মের মুহূর্ত থেকে তার জীবনে নানা কষ্ট ও বাধা প্রতীক্ষা করছে তাকে আঘাত হানবার জন্য। কিন্তু সেই বাঁধাগুলির হাত থেকে ত্রাণ পাবার জন্য সে নানা মন্ত্র শেখে ও নানা বস্তু ব্যবহার করে। আর দলের পুরোহিতের স্বল্পজ্ঞান তাদের জীবনকে সুন্দর করবার গোপন কথা হয়তো জেনেছিলো নিভৃতে নানা চিন্তার দ্বারা।
এই মানব-মানবী নানরকমের পাথরও দেহে পরতো।
তারপর বহুকাল পার হল। তাম্র প্রস্তর যুগের পর থেকেই মানবজাতি নানা দতপ্রকার কারুকার্য করা অলংকার ও তার সঙ্গে রত্ন ব্যবহার করে। এই ব্যবহার নিছক দেহ-সজ্জা নায়- সেই ফেলে আসা দিনের সরণী ধরে তাদের মনে প্রবেশ করেছিলো ভবিষ্যৎ জীবনের অজানা আতঙ্কের অবর্ত থেকে উদ্ধার পাবার প্রয়াশ। তাই তারাও পূর্বপুরুষদের প্রদত্ত মন্ত্রশুদ্ধিতে প্রাণবন্ত অলংকার ও রত্নের ব্যবহার রীতি ও নানা মন্ত্র এবং মূল ধারণ করার আগ্রহে অগ্রাহান্বিত হয়ে পড়ে।
বিশ্বের সুপ্রাচীন সভ্যতা সিন্ধুজনপদ সভ্যতার যুগে সেই মানব মানবী ব্যাপকভবে নানা ধাতুর অলংকার ও রত্ন ধারণ করতো; করতো নান দেব-দেবীর পূজা, নানা রকমের যন্ত্রের দ্বারা নিজেদের রক্ষা করবার চেষ্টা। তার সেঙ্গ এলো মানব জাতিকে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করবার জন্য দৈবের সাহায্য লাভের প্রচেষ্টা।সেটাই লিঙ্গদেববাদ অথবা লিঙ্গ-যোনির নিবিড় আরাধনা।যা সূর্য রশ্মির মতো ছড়িয়ে পড়লো মেসোপটেমিয়া, সুমেরীয়, কাবালা ও মিশরের বুকে। তখনো কিন্তু বহিরাগত আর্যদের কোন স্পন্দন ভারতের বুকে পড়েনি।
সিন্ধুজনপদ সভ্যতাকে যদি ঐতিহ্যমণ্ডিত সভ্যতার ঊষালগ্ন ধরা হয় তাহলে দেখবো সেখান থেকে জ্যোতিষ, তন্ত্র-মন্ত্র ও পূজার অরুণের হলুদ ঝরা দিন। কোথায় তখন বহিরাগত আর্যদের আসার আশা? মনে রাখতে হবে এবং আমি বার বার বলছি সিন্ধুজনপদ সভ্যতাই পৃথিবীর বুকে যে নতুন ও চিরন্তন প্রথার সূত্রপাত করলো তা হলো তন্ত্র ও মন্ত্রের পরিপূর্ণতা। আদিম মানুষ নগ্নদেহে বৃক্ষের রস দিয়ে যে সব উল্কি পরতো এবং দেহে জীবহাড় ও দাঁত পরতো তা কিন্তু তন্ত্রের উদয়লগ্ন। মারণ, উচাটন, বশীকরণ, শান্তি ও মিলনের প্রচেষ্টা তার মধ্যে ছিলো তাতে সন্দেহ নেই। সেই বস্তুকেই আরো কুলীন করলো সিন্ধুজনপদ সভ্যতা। এই সভ্যতার যে লিপি পাঠ এখনো উদ্ধার হয়নি তাতে এটা কিন্তু প্রমাণিত হয় না- তারা বহিরাগত আর্যদের চেয়ে অনর্বর চিন্তাশক্তি নিয়ে বাস করতো। তারা যে অট্টালিকা, যে উপাসনাগার, যে মাটির মূর্তি ব্রোঞ্জের মূর্তি ও অলংকার এবং যে সব প্রতীক ব্যবহার করতো বা তৈরি করতো তাতে তাদের চিন্তাশক্তির সূক্ষ্মাতাই বোঝায়। এবং তারা শিখেছিলো অতি গোপন বিদ্যা ও পূজা। তা হলো জ্যোতিষ ও তন্ত্র।
পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকরা ভারত সম্পর্কে সর্বদাই ইতরবিশেষ কথা বলে চলেন। তাঁরা যতই প্রমাণ করবার চেষ্টা করেন বহিরাগত আর্যরাই ঋগ্বেদ রচনা করে ভারতের আদিম মানুষকে সভ্যতার আলোকের সামনে এনেছেন, ততই এই সব পণ্ডিতদের নয়ন সম্মুখে প্রতিভাত হয় সিন্ধুজনপদ সভ্যতা। তখন আমাদের মনে হয় এই সব প্রাচ্যবাদীরা ককত সংকীর্ণমনা ও কত নীচু জাতের নিন্দুকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।
বেদ বহিরাগত আর্যদের সৃষ্টি হলেও তাদের উপর সিন্ধুজনপদ সভ্যতার প্রভাব অনেক পড়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে- বহিরাগত আর্যরা ছিলো পশুপালক ও কৃষিসভ্যমানব। তারা তখনো নগর সভ্যতাকে চিন্তা করতে পারেনি। আর অপরদিকে সিন্ধুজনপদ সভ্যতা একাধারে নগর জীবনের সঙ্গে কৃষিজীবন ও পশুপালকের জীবনের সমন্বয় সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল। তাই তারা জ্যেতিষ ও তন্ত্রকে এতোখানি প্রকাশ করতে পেরেছিলো।
বেদের আর্যরা অবশ্য ভাগ্যকে সুপ্রসন্ন করাবার জন্য উন্মুখ হয় কিন্তু এই বিদ্যা শিখেছিলো সিন্ধুজনপদ সভ্যতার কাছ থেকে।তারা অলংকার ও নানাবিধ রত্নও মন্ত্রপূত করে ব্যবহার করা শিখেছিলো। তাদের যে ভবিষ্যৎ বক্তা তারা বরতে ঋষি নাম পেলেও পশ্চিম এমিয়াতে এরা ছিলে Magi নামে পরিচিত।এই সম্প্রদায় নর-নারীর ভাগ্য বিচার করে অশুভ ভাবকে নষ্ট করবার জন্য রত্ন, ধাতু ও মন্ত্র দ্বারা শোধিত বস্তু ব্যবহার করতে দিতেন। এই জন্য তাঁরা ছিলেন সমাজে সবার পূজ্য।
এই সব তন্ত্রমন্ত্র এবং রত্ন ধারনের প্রচার বৈদিক যুগেও ছিলো। আমাদের মনে রাখা দরকার বেদের ক্রিয়াকাণ্ডই তন্ত্রের বাহক মাত্র। পার্থিব বস্তুকে সুন্দরভাবে লাভ করাই এই ক্রিয়াকাণ্ড। এই ক্রিয়াকাণ্ডেরে মন্ত্রলোতে আমরা দেখি-ইন্দ্র, বরুণ, রুদ্র প্রভৃতি দেবতার কাছে শত্রুবিনাশের জন্য অধিক শস্যের জন্য, ভূমির ও নারীর উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধির জন্য, ভাগ্যকে সুপ্রসন্ন করবার জন্য আকুল প্রার্থনা ও তার সঙ্গে সঙ্গে যজ্ঞে হবিঃ দোয়া এই দাও দাও মন্ত্রের মধ্যে তন্ত্রের হিরণ্যগর্ভ মত্যের দ্বারা আবৃত হয়ে আছে। বিভিন্ন রোগ থেকে উদ্ধারের জন্য নানা মণির ব্যবহার, নানা মন্ত্রের দ্বারা হোম করা ও কবচ ধারন প্রথা সুন্দর ও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে অথর্ববেদে। সেখানে জ্যোতিষ ও তন্ত্র নিজস্ব আসন লাভ করেছে। যেমন অথর্ববেদের দশম খণ্ডের প্রথম অণুবাকে দেখি- বরণ নামক মণির প্রশংসা, ধারণবিধি, সর্পবিষের মন্ত্র ও চিকিৎসা, শান্তি কর্মানুষ্ঠান, তৃতীয় ও চতুর্থ অণুবাকে দেখি শক্রনাশাদি কাজে নানারকম মন্ত্র ও মণি ধারণের বিধান; ঙ্কম্ভ নামক সনাতন দেবতার স্তুতি ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদন, পঞ্চম অণুবাকে শতৌদন যজ্ঞের মন্ত্রাদি এবং দেবীরুপা গভীর স্তুতি। উক্ত বেদের একাদশ কাণ্ডের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও পঞ্চম অনুবাকে আয়ুষ্কামনায় বিবিদ মন্ত্র, শত্রুজয়ের মন্ত্র ইত্যাদি। শুধু তাই নয়-অথর্ববেদে দেখি বন্ধ্যা নারীর পুত্র হবার উপায়, মন্ত্র, যজ্ঞ, মণি ধারণ, মহাশান্তিকর্ম, অভয় প্রার্থনা, শস্যগৃহের রক্ষা, কবচ, জঙ্গিড়মণি ধারণ প্রভৃতির মন্ত্র।
মহাভারতের যুগে জ্যোতিষ শাস্ত্রও তন্ত্র শাস্ত্র বিরাটভাবে উৎকর্ষতা লাভ করেছিলো।তা আমি এই গ্রন্থের মধ্যে আলোচনা করেছি।এখন আমি আপনাদের কাছে রত্ন ও মন্ত্রের গোপন কথার প্রথম পাঠ দেবার চেষ্টা করবো।তা হলো আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা, পুরাণ ইতিহাস ও তন্ত্র গ্রন্থ থেকে নেওয়া।
ব্যবহারযোগ্য রত্নাদির নামঃ
আমরা চুনী, চন্দকান্তমণি, প্রবাল, পান্না, পোখরাজ, হীরা, নীলা, গোমেদ ও বৈদুর্যমণি- রত্নকেই শ্রেষ্ঠ বলে জ্ঞান 

কোন মন্তব্য নেই:

পুরাতন পোষ্ট গুলি দেখুন